করতোয়া নদী হত্যা: চলছে চাষাবাদ: ভয়ের ভবিষ্যৎ

Ads

করতোয়া নদীর নামটি দুটি বাংলা শব্দ কর বা হাত এবং তোয়া বা পানির সমন্বয়ে গঠিত৷ পৌরাণিক কিংবদন্তি আছে, নদীটি পার্বতীকে বিয়ে করার সময়ে শিবের হাতে ঢালা পানি থেকে তৈরি হয়েছিলো৷

মহাভারতেও উল্লেখ আছে করতোয়া প্রাচীন ও পবিত্র নদী৷ এই নদীর দুই পাড়েই গড়ে উঠেছিলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা পুন্ড্রনগর। প্রাচীন শ্রাবস্তী নগরীও এই নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছিলো বলে আলাপ আছে৷ পৌরাণিক কারণেই শুধু না আধুনিক বগুড়া শহরের কারণেও করতোয়া নদীটি গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে বগুড়া শহর ছাড়াও শেরপুর ও গোবিন্দগঞ্জের মতো প্রাচীন জনপদ গড়ে ওঠে এই নদীতীরে।

করতোয়া নদীর চারটি ধারার মধ্যে দুটি ধারার সংযোগস্থলে গোবিন্দগঞ্জের খলসীতে ২৫ বছর আগে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে নির্মিত হয় জলকপাট। সেই থেকে জলকপাটের এক পাড়ের নদী জলভরা বহমান; অন্য পাড়ে শুষ্কপ্রায় নর্দমার আকার ধারণ করেছে। তাতে অবশ্য অনেকের সুবিধা হয়েছে। নদীর বুক শুকিয়ে আসায় নদীর জমি দখল করে নিয়েছে বিশেষ কৃষক গোষ্ঠী।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, জলকপাটই করতোয়ার মৃত্যুর কারণ। এ নিয়ে তারা কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছে বগুড়া ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। কিন্তু বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ওই চিঠির ব্যাপারে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই অবস্থা বগুড়া জেলা প্রশাসকেরও। ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নদী শুকিয়ে গেল, অথচ কারোরই কোনো ভাবান্তর না হওয়া ভয়ের ও হতাশাজনক।

উত্তরাঞ্চলের একসময়ের প্রমত্তা নদী করতোয়া এখন যেন মৃতপ্রায়। বেশির ভাগ স্থানেই কোনো পানি নেই। বগুড়া জেলার প্রবেশমুখ শিবগঞ্জ উপজেলার পলাশী পয়েন্ট থেকে মহাস্থান সেতু পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার নদীর বুকের বেশির ভাগ স্থানেই চলছে চাষাবাদ। কোথাও তৈরি করা হয়েছে বীজতলা, কোথাও রোপণ করা হয়েছে বোরো ধান, আবার কোনো কোনো এলাকায় রয়েছে আলুর ক্ষেত।

নদী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি মত রয়েছে যে পানি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ভুল বাঁধ ও জলকাঠামো নির্মাণও নদীমৃত্যুর অন্যতম কারণ। করতোয়ার বেলায় এটাই ঘটেছে। এ বিষয়ে নদী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আঞ্চলিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বগুড়া ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বই এখানে বেশি। করতোয়ার পুনর্জীবন এবং এর ওপর দখল-দূষণ, চাষাবাদ প্রতিরোধে প্রকল্প গ্রহণের এখনই সময়। প্রশাসনের অপরিণামদর্শিতায় একটি পৌরাণিক নদীর এমন করুণ অপমৃত্যু সহ্য করা যায় না।’

শিবগঞ্জ উপজেলা মহাস্থানগড়ের বাসিন্দা  মারুফ তোহা জানালেন, ৩৫ কিলোমিটার নদীর ১০টি পয়েন্টে কিছুটা পানির অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে গুজিয়া, সাদুল্যাপুর, দেওয়ানতলা, আমতলী, শিবগঞ্জ হাটের পূর্বপাশ, উপজেলা সদরের চিকাদহ, পৌরসভার পেছনের অর্জনপুর, পার আচলাই, মহাস্থানের গোবিন্দভিটা ও শিলাদেবীর ঘাটে পানি আছে। এই ১০ পয়েন্টে পানির অস্তিত্ব থাকলেও তা প্রবহমান নয়। এসব স্থানে নদীর গভীরতা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ডোবার আকৃতি ধারণ করে পানির দেখা মিলছে। এ ছাড়া অন্য এলাকায় পানি একেবারে নেই বললেই চলে।

নদীর বুকে চাষাবাদ করে খুশি এলাকার কৃষকরা। শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুল্যাপুর এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন জানান, নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে অন্যান্য কৃষকের মতো তিনিও বোরো ধান রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বর্ষা-বাদল না হলে ছয় মাসের খোরাক ঘরে তুলবের পারমো। সব বছর ধান ঘরোত তোলা যায় না। দেখা যায় খুব ঝরি (বৃষ্টির স্থানীয় নাম) হলো তাহলে লদীর পানিত ধান তলে গেলো৷

দেবীপুর গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লদীর মাটিত ধান লাগালে সার-খৈলের দরকার পড়ে না। পলি মাটি তো, এমনি ধান ভালো হয়। যিবার পানি একেবারেই শুকে যায়, সেই বার খালি শ্যালো দিয়ে একটা সেচা দেওয়া লাগে।’ একই গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন জানান, নদীর তীরে যাদের জমি আছে তারাই সাধারণত নদীর জায়গায় আইল দিয়ে ধান চাষ করে। এ ক্ষেত্রে উভয় তীরের জমির মালিক জায়গা ভাগাভাগি করে নিয়ে চাষাবাদ করে থাকেন।

যোগাযোগ করা হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড শিবগঞ্জ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) শাখার কর্মকর্তা আব্দুল হাই বলেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলা পর্যন্ত ১২৩ কিলোমিটার করতোয়া নদীর অবস্থাই করুণ। যেহেতু শিবগঞ্জ উপজেলার পাশেই রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়েছে, এ কারণে প্রভাবটা শিবগঞ্জে বেশি। করতোয়ার প্রাণ ফেরাতে দুই হাজার ৯৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে যে প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, সেটি পুরো অনুমোদন হলে করতোয়া আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

তিনি বলেন, ওই প্রকল্পের মধ্যে বগুড়া শহর অংশের ১৭ কিলোমিটারকে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে তা অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অবশিষ্ট অংশ অনুমোদিত হলে ১২৩ কিলোমিটার দখল ও নদীর বুকে চাষাবাদ করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

Ads
আপনি এটাও পছন্দ করতে পারেন
Loading...