সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তেল ফসলের মধ্যে অন্যতম। সরিষা একটি রবি ফসল। এটা সাধারণত শীত কালে হয়ে থাকে। সরিষায় ২০-৩০% আমিষ রয়েছে। যা শক্তি, বৃদ্ধি ও ক্ষয় পূরণ রক্ষণাবেক্ষণে সহযোগিতা করে থাকে। তেল বীজের উৎপাদনের দিক থেকে এর অবদান প্রায় ৭০%। খাবার রান্না বান্নায় এটি খুবই জনপ্রিয়। শরীরে ও মাথায় সরিষার তেল ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হয়। সরিষার বীজ থেকে তেল করার পর খৈল বের হয় যা উওম গো- খাদ্য। খৈল সারের কাজও করে থাকে। খৈলে ৬.৪% নাইট্রোজেন থাকে। বৃষ্টির পানি জমে না এমন সকল জমিতে সরিষা করা যায়। এবং জমি সমতল হতে হবে। সরিষার বাংলাদেশি জাতের মধ্য ভাল টরী, কল্যাণীয়া, সম্পদ, সোনালী,রাই-৫, দৌলত, বারি সরিষা-৬,৮ সম্বল ইত্যাদি।
সরিষা রবি ফসল হওয়ায় পানি সেচের প্রয়োজন কম তবে ক্ষেতের অবস্থা বুঝে সেচ প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় ১৪টি রোগ দ্বারা সরিষা আক্রান্ত হয়ে থাকে, এর মধ্যে ৯টি ছত্রাকজনিত, ১টি ব্যাক্টেরিয়াজনিত, ২টি ভাইরাসজনিত, ১টি নেমাটোড এবং ১টি সম্পূরক উদ্ভিদ (অরোবাংকি)।
পোকা ও রোগ দমন : পোকার আক্রমণের মধ্য জাব, প্রজাপতি, বিছা-পোকা ক্ষতি করে। জাব পোকার আক্রমন হয় মারাত্বক। জাব পোকা এক ধরনের রস নিঃসরণ করে, ফলে তাতে সুটিমোল্ড ছত্রাক জন্মে এবং আক্রামত্ম অংশ কালো দেখায়। এজন্য ফল ঠিকমত বাড়তে পারে না, বীজ আকারে ছোট হয় । বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। ফল ধারণ অবস্থায় বা তার পূর্বে আক্রমণ হলে এবং প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে। অরোবাংকি নামক সপুস্পক পরজীবীর কারনে গাছের মূলে আক্রমণ হয়।
প্রতিকারের ব্যবস্থা : আগাম চাষ আশ্বিনের শেষ ভাগ ও মধ্য-কার্তিক (অক্টোবর) অর্থাৎ আগাম সরিষা বপন করলে জাব পোকার আক্রমণের আশংকা কম থাকে। ডিটারজেন্ট পাউডার ও নিমের বীজের নির্যাস ভাল করে মিশিয়ে স্প্রে করলে আক্রমণ কমে। এছাড়া আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড প্রতি লিতার পানিতে ০.৫ মিলি (টিডো/ইমিটাফ/বিলডর) বা থায়োমেথোক্সাময(একতারা/ম্যাক্সিমা/জুম) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে স্প্রে করে দিতে হবে। প্রতি গাছে ৫০ টির বেশি পোকা থাকলে ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি বা সুমিয়িথন-৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি হারে মিশিয়ে বিকালে স্প্রে করতে হবে।
পরজীবী উদ্ভিদজনিত রোগ : সরিষার পরজীবী উদ্ভিদের মধ্যে অরোবাংকিই প্রধান। সরিষা গাছেল শিকড়ের সাথে এ পরজীবী উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপন করে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। এর ফলে পরজীবী আক্রান্ত সরিষার গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়। অরোবাংকি এক প্রকার সপুষ্পক পরজীবী উদ্ভিদ এবং এর বংশবৃদ্ধি সরিষা গাছের উপর নির্ভরশীল। এর বীজ মাটিতেই অবস্থান করে। মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, সেচের পানি প্রভৃতির মাধ্যমে অরোবাংকির উৎপত্তি ও বিস্তার ঘটে। বারবার একই জমিতে সরিষা পরিবারের ফসল চাষ করলে এ পরজীবীর বিস্তার ঘটে।
প্রতিকার :
-ফুল আসার পূর্বে পরজীবী উদ্ভিদ জমি হতে তুলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
-পরিমিত হারে টিএসপি সার ব্যবহার করতে হবে।
-পূর্বে এ রোগ আক্রান্ত জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে।
-আগাছা নাশক যেমন ২,৪-ডি ছিটিয়ে পরজীবী উদ্ভিদ দমন করতে হবে।
পাতা ঝলসানো রোগ (Alternaria blight) : অলটারনারিয়া ব্রাসিসি (Alternaria brassicae) এবং Alternaria brassiaicola নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয় এবং বীজ বিকল্প পোষক ও বায়ুর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৭% এর অধিক এবং তাপমাত্রা ১২-২৫ ডিগ্রি সে. ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। এ রোগ প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নিচের বয়স্ক পাতায় ছোট, বাদামি গোলাকার দাগ আকারে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে এ দাগ আকারে বড় হতে থাকে। গাছের পাতা, শুটি, কাণ্ড ও ফলে গোলাকার গাঢ় বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগগুলো ধূসর, গোলাকার সীমা রেখা দ্বারা আবদ্ধ থাকে। অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয় বড় দাগের সৃষ্টি করে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়। আক্রান্ত শুঁটি থেকে পাওয়া বীজ ছোট, বিবর্ণ এবং কুঁচকে যায় এবং ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
রোগের প্রতিকার :
– রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাতের সরিষার চাষ করতে হবে। ধলি, দৌলত, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮ ইত্যাদি জাত কিছুটা পাতা ঝলসানো রোগ সহনশীল।
– সঠিক সময়ে বীজ বপন করতে হবে অর্থাৎ অক্টোবরে শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ বপন করতে হবে।
– সুস্থ সবল জীবাণু মুক্ত এবং রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
– সরিষার মাঠে সময়মতো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে বিশেষ করে বথুয়া পরিষ্কার করতে হবে।
– অনুমোদিত মাত্রায় পটাশ সার ব্যবহার করলে পাতা ঝলসানো রোগের আক্রমণ কম হয়। জমিতে পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ফসল কর্তনের পর আক্রান্ত গাছের পাতা জমি থেকে সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
– প্রতি কেজি বীজ ২.৫ গ্রাম হারে প্রভে´ ২০০ ডব্লিউ পি দ্বারা শোধন করে বপন করতে হবে।
– ১০০ গ্রাম নিমপাতায় সামান্য পানি দিয়ে পিষিয়ে তার রস ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলে ১০ দিন অন্তর ৩ বার গাছে প্রয়োগ করলে রোগের আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।
– এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি শতকরা ০.২ ভাগ হারে (প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম ছত্রাকনাশক) পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ৩ বার পুরো গাছে ছিটিয়ে স্প্রে করলে এ রোগের আক্রমণ থেকে ফসলকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব।