করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। বন্ধ রয়েছে যান চলাচলও। এমন অবস্থায় সবচেয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে দেশের কৃষি অর্থনীতি। পোল্ট্রি, ডেইরী ও মৎস্য খাতে ধস নেমেছে আগেই। এখন আবার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বোরো ফসল ঘরে তোলা নিয়েও। দেশজুড়ে টানা অঘোষিত লকডাউনে ধান কাটার শ্রমিকের অভাব। একই সঙ্গে হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার পূর্বাভাস ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শঙ্কা রয়েছে ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়েও।কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি মওসুমে ৪৩ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। মওসুম অনুযায়ী মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের শেষ সময়ের মধ্যে ধানা কাটা হয়। প্রতি বছর এ সময়ে বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটার কাজে যোগ দেন কৃষি শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এক প্রতিবেদনে জানায়, ৩৭টি জেলায় শ্রমিক উদ্বৃত্ত আছে এবং ২৬ জেলায় শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু ‘লকডাউনের’ কারণে নিজ জেলা থেকে বের হতে পারছেন না এসব শ্রমিক। এতে ক্ষেতেই প্রায় ২০ লাখ টান ধান বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের আগাম বন্যার পূর্বাভাস শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ভারতের মেঘালয় ও আসামের বরাক অববাহিকায় ১৫০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার এবং ত্রিপুরা অববাহিকায় ১০০ থেকে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে পাহাড়ি ঢলের কারণে মেঘনা অববাহিকার নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে এবং হাওরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা হতে পারে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, হাওরাঞ্চলের ৭টি জেলায় ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সতর্কতা অনুযায়ী হাওরের এ ফসল রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছেন।
উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার বলেন, বিশেষ ব্যবস্থায় হলেও শ্রমিকদের চলাচল স্বাভাবিক করে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, কৃষি পণ্য এবং কৃষি শ্রমিক কোনটাই নির্দিষ্ট কোন এলাকার মধ্যে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। কিন্তু ‘লকডাউন’ সেটাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। এটাকে সচল করতে হবে। বেকার শ্রমিকদের কাজে ফেরার সুযোগ দিতে হবে।
চলমাল পরিস্থিতিতে শুধু পুরুষরা নয়, নারী শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। যারা রাইস মিল, চাতালসহ কৃষির নানা ক্ষেত্রে কাজ করছেন তাদের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়েছে। যদিও সরকার কৃষি খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এর বণ্টন ও প্রকৃত কৃষকের প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে অনেকের।
ফরিদা আক্তার বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ যেটা ঘোষণা করা হয়েছে সেটা কারা-কখন পাবেন জানিনা। তবে এই মুহূর্তে কৃষি খাতের ক্ষতিগ্রস্থ ওই লোকগুলোর পকেটে নগদ টাকা দিতে হবে। তিনি বলেন, কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ এখন আরও অনেক বেশি। তারও বেকার সময় পার করছেন। বুঝতে হবে একজন নারী যখন কাজ হারায় তার সঙ্গে পুরো পরিবারের জীবিকাও হারিয়ে যায়। তাই পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ, ‘অনাহারের আভাস’ কিন্তু শুনতে পাচ্ছি।
এরও আগে, ধস শুরু হয়েছে পোল্ট্রি, ডেইরী ও মৎস্য খাতে। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) জানায়, দেশে প্রতি সপ্তাহে এক কোটি ৩০ লাখ মুরগির বাচ্চা ফুটানো হয়। করোনার ভীতি ও ‘লকডাউনের’ কারণে খামারিরা বাচ্চা কিনতে পারছে না। ফলে সপ্তাহে কমপক্ষে এক কোটি মুরগির বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হচ্ছে।
পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে দিনে প্রায় ১৪০ লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদিত হচ্ছে, যার বেশির ভাগই বিক্রি হচ্ছে না। আর মৎস্য খাত নিয়ে বলা হয়েছে, মাছের পোনা সংগ্রহ করতে পারছেন না মাছ চাষীরা।
এছাড়াও অর্থনীতির অন্যান্য ঝুঁকিও প্রকট হয়ে উঠছে । তৈরি পোশাক খাতে অর্ডার বাতিলের ধারা অব্যাহত রয়েছে। পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর পরিচালক আসিফ ইব্রাহীম জানান, এ পর্যন্ত ৩.১৫ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে।
রপ্তানি আয়ে ভাটায় এটা নতুন অনুসঙ্গ। কারণ, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কম ছিল ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং আগের বছরের তুলনায় কম ছিল ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর মার্চ মাসে আগের বছরের মার্চের তুলনায় প্রবাসী আয় কম ছিল ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারির চেয়ে কম ছিল ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
তারপরও অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ ঝুঁকিগুলোকেই বড় করে দেখছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, প্রবাসী আয় কিংবা রপ্তানি আয়ের মতো এক্সটার্নাল ঝুঁকির তুলনায় স্থানীয় সংকটগুলোই প্রকট হয়ে উঠছে বেশি। আর্থিক খাত, ব্যাংকিং খাত এবং রাজস্ব আদায়ে ত্রুটিসহ প্রায় সব খাতের দুর্বলতাগুলোই এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। ইস্যুটি স্বল্প মেয়াদে স্বাস্থ্যগত সমস্যা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এমনিতে ঋণখেলাপের একটি প্রবণতা বাংলাদেশে আছে। তারা যাতে এই সুযোগটা না নিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
একই সঙ্গে সংকট মোকাবেলায় সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এই দুই অর্থনীতিবিদ। তাদের মতে, ঝুঁকি মোকাবেলায় মাঠে সরকার একাই কাজ করছে। সেটা চিকিৎসা সেবা ও অর্থনীতি উভয় খাতে। কিন্তু দরকার এখন সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়। কারণ, তাদের অভিজ্ঞতা এবং নেটওয়ার্কিংয়ের সুবিধা নেয়টা এখন খুবই জরুরী।
করোনা প্রতিরোধে বেসরকরি সংস্থার প্রয়োজনীতার প্রসঙ্গে ফরিদা আক্তার বলেন, চিকিৎসক-নার্সের আগে মাঠ পর্যায়ে দরকার স্বোচ্ছাসেবীদের একাধিক গ্রুপ। যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করবে, রোগীকে শনাক্ত করবে। চীনের উহানে আমরা সেটা দেখেছি। এই পদ্ধতিতে না এগুলে সরকারের একার পক্ষে শুধু চিকিৎসক-নার্স দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব নয়।