জলবায়ুর প্রভাবে কৃষিতে অশনি সংকেত হুমকির মুখে জীবন-জীবিকা
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ’। এ কথার অর্থ, মাঘের শেষের বৃষ্টিপাতে রাজা ও দেশের কল্যাণ হয়। বহুকাল ধরে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে খনার এ বচন প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ন্ন বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুর হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরিসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। প™§া, মঘনা ও ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদী গুলোতে মা মাছ এসে ডিম পারে। এ সময় পাট জাগ দিতে প্রয়োজন হয় পাানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। শীতও তার প্রচলিত সময়ের নিয়ম মানছে না। আবার বন্যাও তার ব্যাকরণ ভুলে হানা দিচ্ছে অসময়ে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে।
এবার কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিকে হাড় মানিয়েছে। এবারের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। শুধু রংপুরে মাত্র ১৪ ঘন্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারা দেশে প্রতি বছর ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত শুধু বাংলাদেশ নয়, আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ বিশ্ব জুড়েই। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে, সেটি স্বাভাবিকের চাইতে গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম।
জলবায়ুর প্রভাবে উপকূলের মানুষকে আট থেকে দশ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলসি পানি কিনে আনতে হয়। উপকূলীয় এলাকায় এক কলসি পানির দাম পঞ্চাশ থেকে আশি টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়। দেশের উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলেও সুপেয় খাবার পানি এখন দ্ষ্প্রুাপ্য।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সুপেয় পানি পাচ্ছেন না প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে সুপেয় পানি সুবিধার অভাবে। দেশের উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। আশঙ্কাজনকভাবে ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবতনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি গবেষকরাও অসময়ের বৃষ্টিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। ষড়ঋতুর এ দেশে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ হেমন্ত ঋতু। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। অক্টোবরের শেষেও শ্রাবণের মতোই বৃষ্টি ঝড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বৃাষ্টিপাতের এই আচরণ স্বাভাবিক নয় বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও খরার ধরণ পাল্টে যাচ্ছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদে মৌলিক অধিকারের সব যোগান আসে কৃষি খাত থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জনজীবন যে কত বেশি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে তা এখন বেশ দৃশ্যমান। মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়সহ অনেক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে একদিকে ফসলের ফলনচক্র ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষিজমি হারাচ্ছে চাষের স্বাভাবিক উর্বরাশক্তি।
এক দশক আগেও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের অবদান ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, কৃষি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ যোগান দিয়ে থাকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যাণ ব্যুারোর (বিবিএস) কৃষি শুমারি ২০১৯ এ মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপি’তে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কৃষি পেশায় নিয়োজিত আছেন। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তার ওপর প্রভাব বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ দারিদ্র্য বাড়াতে পারে।
খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে বাংলাদেশের কৃষি খাত। জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ফসলি জমির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে বলে নতুন এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণা ভিক্তিক এ প্রতিবেদন তৈরী করে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিশ^ব্যাংক। ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (সিএসএআইপি)’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২০৪৫ সালের মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় ২৪ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নয় শতাংশ ফসলি জমি কমতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় ছয় শতাংশ এবং অন্য অঞ্চলে দুই শতাংশ আবাদি জমি কমবে। মাটির লবণাক্ততা উপকূলীয় জমিগুলোর ৬২ শতাংশকে প্রভাবিত করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ আট কিলোমিটার উত্তরে অগ্রসর হওয়ার আশংকা করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের মূল জাতীয় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলেও বিশ^ব্যাংক সর্তক করেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠ সর্বোচ্চ এক মিটার উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হতে পারে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরণ পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি বছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ করে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে।
আবহাওয়া বিশ্নেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এল-নিনোর শিকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এসব দেশে কোনো বছর কৃষি মৌসুমে তীব্র খরা হচ্ছে। আবার কোনো বছর অতিবৃষ্টি বা ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণের প্রভাব কৃষির ওপর সরাসরি পড়ছে। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায়ও বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশংকা করছেন কৃষিবিদরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করছেন দেশের কৃষক। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষি খাত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে সব্বোর্চ ঝুঁকি বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থেকে দেশের কৃষিকে রক্ষার জন্য সরকার জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধান ও গমের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে বলে আশংকা করছেন বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেশে ধান ও গম উৎপাদন করতে হলে জলবায়ু সহিষ্ণু ও উষ্ণতা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। জলবায়ুর থাবায় প্রায় প্রতি বছরই খরা, বন্যা, ঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগে কৃষি ও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে কৃষকদের বাঁচাতে শস্যবীমা চালু এবং কৃষিপণ্যের আগাম মূল্য নির্ধারণে একটি জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করা জরুরী। জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান বেডে ফসল চাষে কৃষকদের বিশেষ প্রনোদণা দেয়া এবং এই মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আউশ ও আমন ধান পুরোপুরিই বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির দেখা মিলে না। জলবায়ু পরিবর্তনে হচ্ছে ঘন ঘন বন্যা, বেড়েছে ঘুর্ণিঝড়ের সংখ্যা। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা কৃষিকে বদলে দিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বহু ধানের জাত। অনাবৃষ্টিতে খরাসহ বিভিন্ন কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কৃষককে সেচ পাম্প বসিয়ে আমনের ক্ষেতে পানি দিতে হয়। ধান উৎপাদনে সেচ কাজে কৃষককে উৎপাদন খরচের ৬৬ শতাংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এক কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লিটার পানি খরচ করতে হচ্ছে।
আলতাব হোসেন
সিনিয়র সাংবাদিক
বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক যায়যায়দিন।